ব্রা এর ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের এক আলাদা কৌতুহল রয়েছে। এই ব্রা টা খুলে গেল কিনা ব্রা এর ফিতা টা পিছন থেকে দেখা গেল কি না কিংবা কিছু না পেলে বাইরে থেকে ব্রা এর রঙ টা বুঝা যাচ্ছে কি না এ নিয়ে বাংলাদেশের পুরুষ সমাজে কৌতূহলের অন্ত নেই। আর ব্রা এর সামনে দিয়ে একটু উঁচু হয়ে থাকলে তো কথাই নেই। সারাক্ষণই সুযোগ খুঁজতে থাকে হাত বাড়ানোর। আজ আমরা এমন একটি দিনের কথা বলব যেদিন ব্রা খুলে ফেলায় হচ্ছে আসল দিবস।
ব্রেস্ট ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস মানথ উপলক্ষে ‘No Bra Day’, এই দিবসটি পশ্চিমা বিশ্বে মহা সমারোহে পালিত হয় অক্টোবরের ১৩ তারিখে । ২০১১ সাল থেকে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। তবে ঠিক কী কারণে এই দিবসটি পালন করা শুরু হয় তা একটু ঘোলাটে। যদিও ‘নো ব্রা ডে’ পালনের উদ্দেশ্য মোটামোটি পরিষ্কার। এই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, নারীদের বেশি বেশি করে স্ক্রিনিং এ উদ্বুদ্ধ করা এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা।
এই দিনে ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগী, সারভাইভারসহ সকল নারীকে আহবান করা হয় সারা দিন ব্রা পরিধান ছাড়া থাকতে এবং এভাবেই সব কাজে অংশ গ্রহণ করতে! আর কেউ যদি সেটা করতে না চায় তাহলে অন্তত পার্পল রঙের পোশাক পরে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারেন। পুরুষরাও একই রঙের পোশাক পরে এই দিবসটি পালন করতে পারেন।(১)
এই দিনের ইতিহস ঘাটাঘাটি করে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। তবে যেটুকু ধারনা পাওয়া গেল, তা এরকম। বিশ্বে প্রতি ৮ জন নারীর মধ্যে ১ জন ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। সুতরাং সংখ্যাটি কতো বিশাল ধারনা করলেও ভয় লাগে! ক্যান্সারের শেষ পরিনতি মৃত্যু, তা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এর বাইরেও আরো কিছু ব্যাপার থাকে। বিশেষ করে ক্যান্সারটি যদি হয় ব্রেস্ট ক্যান্সার, যে রোগে মৃত্যুহার আধুনিক যুগে অনেকটাই কমে এসেছে। আর এ রোগটা মূলত নারীদের এমন একটি অঙ্গে হয় যা যুগে যুগে দেশে দেশে নারীত্বের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যের পরিচায়ক, তার চেয়েও বেশি এটি নারীর মাতৃত্বের পূর্ণতা এনে দেয়ার একটি মাধ্যম।
ক্যান্সার যুদ্ধে এই অঙ্গটি হারিয়ে নারীরা প্রায় সময়ই নিজের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংকটের সম্মুখীন হন, হতাশায় ভোগেন। তাদের অনেকেই এই ব্যাপারটা লুকাতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম অঙ্গ ব্যবহার করেন , আর সেটা ঢেকে রাখতে সারাদিন তাদের ব্রা পরে থাকতে হয়। তাই নো ব্রা ডে তে আপনি বিনা ব্রা তে সারাদিন কাটিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন, যেন আপনাকেও এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি না হতে হয়।(২)
আমার ধারনা ছিল, ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি ভুল ধারনা যে, “দীর্ঘক্ষণ ব্রা পড়লে, টাইট ব্রা পড়লে, বা রাতের বেলায় ব্রা পড়ে ঘুমালে ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে”, এই ধারনা থেকে এই দিবসের উৎপত্তি। কিন্তু কোথাও এর সপক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ পেলাম না!
সে যাই হোক, যে দু’টি ওয়েব সাইট উপরের তথ্যগুলো দিয়ে নো ব্রা ডে পালনের আহবান জানিয়েছে, তারাও মনে হলো কনফিউজড, যে ব্রা না পরেই কেন সচেতনতা, স্ক্রিনিং, ফান্ড রেইজিং করতে হবে!
এসব বাদ দিয়ে বরং ব্রা সম্পর্কিত এই প্রচলিত ভুল ধারনা নিয়ে কিছু তথ্য দেই।
ব্রা পরিধানে ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে এই মিথ ছড়ানোর জন্য দায়ী ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত একটি বই, যার নাম ‘ড্রেসড টু কিল’ বা ‘Dressed to Kill’।
বইটির লেখক Sydney Ross Singer এবং Soma Grismaijer বইটিতে দাবী করেন যে, মেয়েদের মধ্যে যারা দিনে ১২ ঘন্টার বেশি সময় ধরে ব্রা পরিধান করে তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা যারা ব্রা পড়ে না তাদের চেয়ে বেশি। তারা আরো বলেন ওয়েসটার্ন কালচারের নারীদেরও এই কারণেই ব্রেস্ট ক্যান্সার বেশি হয়। তারা বলেন যে, ব্রা পড়লে ব্রেস্টের লিম্ফেটিক ড্রেইনেজ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ব্রেস্টের ভেতর টক্সিন জমা হতে থাকে, যা ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণ!(৩)
তাদের এই সিদ্ধান্ত কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফসল নয়, বরং তাদের তথাকথিত দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণের(!) ফলাফল যা রীতিমতো বই প্রকাশ করে সকলকে জানানো হয়! (বোঝাই যাচ্ছে, সে সময় ফেসবুকের মতো এত জনপ্রিয় সোশাল মিডিয়া থাকলে তাদের এতো কষ্ট করতে হতো না!) তাদের এই পর্যবেক্ষণ লেভেল অফ এভিডেন্সে এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। তারপরেও বিজ্ঞানীরা তাদের এই দাবীকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে ভুল প্রমাণিত করেন।
প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ব্রেস্টের লিম্ফেটিক সিস্টেম ব্রেস্টের ভেতর লিম্ফ ড্রেইন করেনা, তারা ব্রেস্টের বাইরে বগলের লিম্ফনোডে লিম্ফ বা লসিকা রস নিষ্কাশন করে। তাই ব্রেস্টের ভেতর লসিকা রস ও টক্সিন জমা হয়ে ক্যান্সার হওয়া সম্ভব না। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত এমন কোন নির্ভরযোগ্য গবেষণা পাওয়া যায়নি যাতে তাদের এই দাবী প্রমাণিত হয়।
১৯৯১ সালের একটি গবেষণা পত্রে প্রাথমিক ভাবে ব্রা কে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকির জন্য কিছুটা দায়ী বলে মনে করা হলেও পরবর্তীতে সেটা স্ট্যাটিসটিকালি সিগনিফিকেন্ট পাওয়া যায়নি। বরং শীর্ণাকায় নারীরা কম ব্রা পরিধান করায় এবং স্থূলকায় নারীদের ব্রা পরিধানের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়ায়, ঘুরে ফিরে সেই দৈহিক স্থূলতাকেই মূল দোষী সাব্যস্ত করা হয়।(৪) তারপর থেকে এই পর্যন্ত এমন কোন গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়নি যা তাদের এই দাবীকে সমর্থন করে।
২০১৪ সালে আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, যেখানে গবেষকরা ১৫০০ জন পোস্টমেনোপজাল নারীদের সাক্ষাৎকার নেন। তাদের কাছে তাদের সারাজীবনের ব্রা পরিধানের ধরন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় । এদের মধ্যে ১০০০ জন ছিলেন ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত, বাকি ৫০০ জন ছিলেন সুস্থ নারী। এতক্ষনে নিশ্চয়ই অনেকেই বুঝে গেছেন যে এটি ছিল একটি কেস-কন্ট্রোল স্টাডি। গবেষকরা এই গবেষণায় ব্রা পরিধানের সাথে, কিংবা ব্রা পরিধানের সময়কালের সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ার মতো কোন সম্পর্কই খুঁজে পাননি।(৫)
একটি দিনের জন্য হলেও আপনার ব্রা খুলে ফেলুন
প্রখ্যাত আমেরিকান সার্জন ডঃ সুসান লাভ তার ‘ব্রেস্ট বুক’ গ্রন্থে এই বিতর্কের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে। তার মতে, এইসব মীথের গোঁড়া হচ্ছে জীবনের অনিশ্চিত ও ভীতিকর অধ্যায়ের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের মনের সুপ্ত বাসনা। মানুষ এমন একটা কিছু চায়, যার উপর সব দোষ চাপানো যায়। আবার তারা এই আশাতে বুক বাঁধে যে, ব্রা পরিহার করলে বুঝি ব্রেস্ট ক্যান্সারকে রোখা যাবে! (৬) কিন্তু, ধন্য আশা কহুকিনী..
মোদ্দা কথা, সারাদিন ব্রা পড়ে থাকা, রাতে ব্রা পড়ে ঘুমানো, টাইট ব্রা, স্পোর্টস ব্রা এসব পরিধানের সাথে, আর যাই হোক, ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোন যোগসাজশ নেই।
ব্রা পরিধানের চেয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যেগুলো ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ! তাদের মধ্যে কিছু কিছু ঝুঁকির উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই, যেমন নারী হয়ে জন্ম নেয়া! আবার কিছু কিছু ঝুঁকি আমরা চাইলেই এড়াতে পারি। যেমন দৈহিক স্থূলতা।
‘নো ব্রা ডে” নিয়ে অনেক কথা বললাম। এবার শুনুন ‘ব্রা ডে” এর কথা! এই দিবসেরও প্রচলন হয় ২০১১ সালে। প্রচলন করেন কানাডার প্লাস্টিক সার্জন ডঃ মিশেল ব্রাউন। এই ব্রা মানে হলো, BRA অর্থাৎ “Breast Reconstruction Awareness” with Buttock Lifts Surgery। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো যাদের ব্রেস্ট সার্জারি প্রয়োজন হয় তাদের জন্য ব্রেস্ট রিকন্সট্রাকশনের সুযোগ সৃষ্টি করা ও ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ২০১৪ সালে বিশ্বের ৩০ টি দেশ এই ইভেন্টে অংশ নেয় এবং অর্থ সংগ্রহ করে। প্রতি বছর ১৮ অক্টোবর এ দিবস পালিত হয়।
এখন ‘ব্রা ডে’ অথবা ‘নো ব্রা ডে’ যেটাই পালন করুন না কেন, (না করলেও ক্ষতি নেই), ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে সচেতন হোন। আসুন, ভুল ধারনা গুলো থেকে সবাই বেরিয়ে আসি। পরিবারের নারী সদস্যটিকে স্তনের চাকা নিয়ে হীনমন্যতায় না রেখে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে প্রকাশে সহায়তা করি। সবাই ভালো থাকবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন